উপলব্ধি
– প্রলয় কুমার নাথ
রবিবারের দুপুরের রান্নাটা নিজে হাতেই রাঁধে তিস্তা। এই দিন বাড়ির রান্নার লোকের ছুটি। আজ মাংসটা বেশ জমিয়ে রেঁধেছে তিস্তা। তার বাবা অবিনাশ বাবু নিজের ঘরেই দুপুরের খাবার খান। বাবার জন্য ভাত মাংস পাতে সাজিয়ে বাবার ঘরের দিকে নিয়ে যেতেই সে শুনতে পেল ঘরের ভেতর থেকে বাবা যেন ফোনে কার সাথে কথা বলছে। খুব ফিসফিস করে কথা বলছেন অবিনাশ বাবু, কি বলছেন তা শুনতে পেল না তিস্তা। তবে কথার মধ্যে বারবার ‘রমা’ নামটা উচ্চারণ করছেন সেটা তার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো তিস্তা। বাবার ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর খাবারের থালাটা রাখতে যেতেই সে দেখল তাকে দেখেই সাথে সাথে ফোন কেটে দিলেন অবিনাশ বাবু। অবিনাশ বাবুর এহেন আচরণে তেমন কোন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো না তিস্তার মুখে, সে শুধু ‘খাবারটা রাখলাম বাবা…খেয়ে নিও’ বলে মিষ্টি হেসে অবিনাশ বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে অনেক কথা ভাবতে লাগল তিস্তা। শুধু আজকে নয় প্রায় প্রতিদিনই এই ‘রমা’র সাথে বাবাকে ফোনে কথা বলতে শুনেছে সে। তার মানে এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে কোনো ‘রমা’র প্রেমে পড়ল নাকি তার বাবা? কথাটা ভাবতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না সে, বরং একটি মুচকি হাসি খেলে গেল তার মুখে। অবশ্য এটা না হওয়ারই বা কি আছে, এই বয়সেও তার বাবা যথেষ্ট সুপুরুষ। লম্বা চওড়া তাগড়াই চেহারা, গায়ের রং যেন ফেটে পড়ছে। তার কাপড়ের দোকানের ব্যবসাটাও রমরমিয়ে চলছে। কোনো মধ্য বয়সী মহিলাই শুধু নয়, অনেক অল্প বয়সী তরুণীরাও এমন মানুষকে প্রণয়ী হিসাবে পেতে চাইবে, এমনটাই অন্তত তিস্তার বিশ্বাস। কিন্তু আজ অবধি কোনো দিন সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেনি, কে এই রমা? তার কারণ কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো পছন্দ করে না তিস্তা, এমনকি তার বাবার ব্যাপারেও নয়। ঠিক যেমন অবিনাশ বাবুও তার একমাত্র মেয়ের জীবনের কোনো সিদ্ধান্তের মাঝে আজ অবধি নিজের কোনো মতামত চাপিয়ে দেননি।
জীবনে কখনো মায়ের দেখা পায়নি তিস্তা। বাবার কাছ থেকে সে জেনেছে যে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মৃদুলা দেবীর মৃত্যু হয়। তাই মায়ের কোনো স্মৃতি অন্তত তিস্তার জীবনে নেই। মাকে শুধু সে বাড়ির পুরোনো ফটো এলবামেই দেখে এসেছে, তার বাবার সাথে বিয়ের সময়ের ছবিগুলোতে। অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন মৃদুলা দেবী, অনেকটা তিস্তার মতই। বিয়ের সাজে অবিনাশ আর মৃদুলাকে খুব সুন্দর মানিয়েছিল প্রতিটা ফটোতে। মাঝে মাঝে তিস্তার মনে হয় বাপ মেয়ের এই সংসারে যদি আজ তার মাও বেঁচে থাকত তাহলে কত ভালো হত! মায়ের মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি অবিনাশ বাবু। তিনিই হয়ে উঠেছিলেন তিস্তার মা বাবা দুটোই। সারা জীবন ধরে কিই বা পেল মানুষটা? তাই এই বয়সে মানুষটা যদি অপর কোনো নারীর প্রেমের স্পর্শ পেয়ে একটু বাঁচতে চায়, তাহলে তাতে তিস্তার কোন অসম্মতি নেই। এর আরেকটা কারণও আছে, তিস্তা আর এই বাড়িতে কতদিন থাকবে? অমিতাভর সাথে তার এনগেজমেন্টর দিন পরের মাসেই ফাইনাল হয়ে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এই বাড়িতে অপর একজন মানুষের খুব দরকার, নাহলে বাবাকে দেখাশোনা করবে কে?
অমিতাভ…মানে ডক্টর অমিতাভ মজুমদার। এই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ইউরোলজিস্টদের মধ্যে এই নামটা খুবই প্রচলিত। তিস্তা যে প্রাইভেট হাসপাতালের বিলিং কাউন্টারে চাকরি করে, যেখানে কম্পিউটারের সামনে বসে ইয়া বড় বড় টাকার অঙ্কে ভরা সব বিল ধরিয়ে দেয় হতভাগ্য কাস্টমারগুলোর হাতে, সেই হাসপাতালেই সপ্তাহে তিন দিন করে বসেন অমিতাভ বাবু। আর সেইদিনগুলোতে পেশেন্টদের লম্বা লাইন লেগে যায় তিস্তার বসার জায়গার সামনে থাকা ওয়েটিং স্পেসে। সত্যিই চিকিৎসা বিজ্ঞানে খুব সফল একটি নাম এই অমিতাভ মজুমদারের। শুধু এই হাসপাতালই নয়, কলকাতার আরো কত নামী দামী মেডিকেল সেন্টার যে তার নামে চলছে তার ইয়ত্তা নেই। অর্থ, যশ আর প্রতিপত্তিতে ভরপুর বছর পঁয়তাল্লিশের এই বিপত্নীক ডাক্তার বাবুটির চোখে ধরেছিল সাতাশ বছর বয়সের সুন্দরী তিস্তা। একদিন নিজের চেম্বারে ডেকে তিনি তিস্তাকে জানিয়েছিলেন নিজের মনের কথা। বলেছিলেন যে তিনি তিস্তাকে বিয়ে করতে চান, এতে শুধু তিনি নতুন করে স্ত্রী সুখ পাবেন তাই নয়, তার একমাত্র মাতৃহারা ছেলেটারও মায়ের অভাব পূর্ণ হবে। অমিতাভ বাবুর কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠেছিল তিস্তা। তার থেকে বয়সে প্রায় কুড়ি বছরের বড় একটি লোক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে যে কি না আবার বিপত্নীক আর এক ছেলের বাবা, এটা ভাবতেই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল তিস্তার। কিন্তু পরমুহূর্তেই কি যেন মনে হতে মুখের ওপর না করতে পারেনি তিস্তা। বারে বারে তার মনে হতে থাকে অমিতাভের মতো এমন অর্থ, পরিচিতি এবং স্বচ্ছলতার শিখরে কি সৌমিক কখনো পৌঁছতে পারবে? কখনো কি সে তিস্তাকে অমিতাভের মত সুখে স্বাচ্ছন্দে রাখতে পারবে? হোক না অমিতাভের বয়সটা একটু বেশি, হোক না সে বিপত্নীক, থাকুক না তার আগের পক্ষের ছেলে…তার মত তিস্তাকে সোনায় মুড়ে সৌমিক কখনো রাখতে পারবে না! তাই কিছু দিন সময় চেয়ে নিয়ে, অবশেষে কলেজ লাইফের প্রেমকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিস্তা রাজি হয়ে গিয়েছিল অমিতাভের প্রস্তাবে।
কিছুদিনের মধ্যেই সৌমিকের সাথে দেখা করেছিল তিস্তা। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে তার প্রথম আলাপ সৌমিকের সাথে। তিস্তার ছিল ইংরেজিতে অনার্স আর সৌমিকের ফিজিক্সে। তিস্তার মতই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সৌমিক। তার বাবা ছিলেন সরকারি কেরানী। উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল সৌমিক, নাহলে ফিজিক্সের মত বিষয়ে এই কলেজের প্রথম মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াটা চাট্টি খানি কথা নয়। অবশ্য শুধু মেধাবীই নয়, সৌমিককে দেখতেও ছিল বেশ সুন্দর। কলেজের প্রথম ফেস্টের সন্ধ্যায় তিস্তার সাথে পরিচয় হয় সৌমিকের। প্রথম দেখাতেই ওকে ভালো লেগে গিয়েছিল তিস্তার। সেদিন বিশিষ্ট আমন্ত্রিত গায়কের গানের তালে তালে একসাথে নেচেছিল ওরা দুজনে। জীবনে বাবাকে ছাড়া অপর কোন পুরুষের শরীরের এত কাছে বোধহয় এই প্রথম এসেছিল তিস্তা, তাও আবার এমন একটি ছেলের কাছে যার সাথে তার সেই দিনই পরিচয় হয়েছে। সেদিন সৌমিকের সাদা টি-শার্টের বেশিরভাগ জায়গাই তিস্তার ঠোঁটের লিপস্টিকে লাল হয়ে গিয়েছিল। সৌমিক তিস্তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফিল্মি কায়দায় তাকে প্রপোজ করেছিল। তিস্তার যেন মনে হয়েছিল জীবনে সব কিছু পাওয়া হল। তবে আজ সে বুঝেছে সেদিন কতটা অপরিণত বুদ্ধি ছিল তার। বাঁচতে গেলে জীবনের প্রতিটি ধাপে লাগে অর্থ, মান, খ্যাতি…সেখানে এই শৈশবের মেকি প্রেম কোন কাজে আসে না। আর এই সব দিক থেকেই চুড়ান্ত রূপে পিছিয়ে আছে সৌমিক। কলেজে ঢুকেই উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া ছেলেটার পড়াশোনা যেন ধীরে ধীরে অবনতির পথে এগোতে থাকলো। হয়তো এর কারণ তিস্তার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক। অবশেষে ফার্স্ট ইয়ারেই অনার্স কেটে গেল সৌমিকের, কোনো মতে টেনে টুনে পাশ কোর্স পাশ করে কলেজ থেকে বেরোল সে। স্কুলে পড়াকালীন যে ছেলেটার স্বপ্ন ছিল ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করার, মাস্টার্স করার পথ আজ তার বন্ধ। ঠিক এমনই সময় একদিন হুট করে ইহকালের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন সৌমিকের বাবা। তাই বাধ্য হয়েই চাকরির চেষ্টায় হন্যে হয়ে ঘুরতে হল সৌমিককে। সরকারি চাকরি পাবার ধৈর্য্য তার আর ছিল না, তাই কিছুদিনের মধ্যেই সেলসের একটি স্বল্প মাইনের কাজে ঢুকতে হল তাকে। তাই অমিতাভের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে আর না করতে পারেনি তিস্তা। সৌমিকের সাথে দেখা করে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার সাথে আর কোনূ সম্পর্ক রাখা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়, কারণ অমিতাভের প্রতিপত্তির সাথে সৌমিকের কোন তুলনাই হয় না। সেদিন মুখ বুজে সব কথা শুনে গিয়েছিল সৌমিক, তিস্তা লক্ষ্য করেছিল শুধুমাত্র ছলছল করে উঠেছিল সৌমিকের দু’টো চোখ। কিন্তু মুখে কোন কথা বলেনি সে। অবশ্য বুকটা ভারী ভারী তিস্তারও লাগছিল, কিন্তু কিছুই যে করার নেই…তার শৈশবের প্রেমকে যে হারিয়ে দিয়েছে অমিতাভের সাথে প্রাচুর্যে ভরা নতুন জীবনের হাতছানি!
***
সেদিন ছিল তিস্তার জন্মদিন। বাবার কথামত সেদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিল তিস্তা। বিকালের দিকে অবিনাশ বাবু মেয়েকে বললেন তৈরি হয়ে নিতে, তিস্তাকে সারপ্রাইস দেওয়ার জন্য একটি নতুন জায়গায় নিয়ে যাবেন তিনি। তিস্তা মনে মনে ভাবলো হয়তো কোন শপিং মল বা কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে চায় তার বাবা। তাই বাবার কথামত তৈরি হয়ে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে। রাস্তায় এসে অবিনাশ বাবু একটি ট্যাক্সি ধরলেন। ট্যাক্সির ভেতর বাবার পাশে বসে তিস্তা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো কোথায় তার বাবা তাকে নিয়ে যেতে চায় সেটা জানার জন্য। অবিনাশ বাবুর পথ নির্দেশানুসারে ট্যাক্সিটা একটি জায়গায় এসে থামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে বেশ অবাক হয়ে গেল তিস্তা। এখানে তো কোনো মল বা রেস্টুরেন্ট নেই! রাস্তার ওপারে একটি সুবিশাল বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে যার প্রবেশ দ্বারের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে “Healing Minds Mental Hospital” সেদিকেই এগিয়ে যেতে লাগলেন অবিনাশ বাবু। তার মানে বাবা তাকে একটি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, কিন্তু কেন? অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো তিস্তা! হাসপাতালটির ভেতরে ঢুকে কাউন্টারের কিছু একটা বললেন অবিনাশ বাবু। কাউন্টারের ছেলেটার নির্দেশে একটি ওয়ার্ড বয় এগিয়ে এসে অবিনাশ বাবু আর তিস্তাকে নিয়ে গেল হাসপাতালটার তিনতলার একটি ঘরে। সেই ঘরে ঢুকে তিস্তা দেখল যে হাসপাতালের বেডে জবুথবু হয়ে বসে আছে এক মধ্য বয়সী রোগা চেহারার মহিলা। তাকে আস্তে আস্তে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে এই হাসপাতালেরই একজন তরুণী নার্স। তিস্তা ভালো করে চেয়ে দেখলো চুপ করে বসে থাকা ওই বয়স্ক মহিলাটির দিকে, এক কালে তিনি যে খুব সুন্দরী ছিলেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে…বয়স হলেও তার মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে তিস্তার! আগে কোথায় যেন দেখেছে সে এই মহিলাটিকে! অবিনাশ বাবু নার্সটির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
— “এখন মৃদুলার অবস্থা কেমন আছে, রমা?”
— “আগের থেকে অনেক ভালো, অবিনাশ বাবু। আপনাকে তো বলেই ছিলাম যে ডাক্তার বাবু বলেছেন খুব তাড়াতাড়ি ওনাকে এখান থেকে ডিসচার্জ করতে পারবো!”, বলে উঠলো রমা নামক নার্সটি।
হতভম্ব তিস্তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার মানে এই নার্সটাই হল সেই রমা যার সাথে তার বাবা ফোনে গোপনে কথা বলতো! আর এই মহিলার কি নাম বলল তার বাবা…মৃদুলা! তার মানে এই মহিলা তার মা! হ্যাঁ, এবার সে বুঝতে পারছে এই মুখেরই অল্প বয়সের ছবি বাড়ির পুরোনো এলবামে সে দেখেছে! তার মানে তার মা বেঁচে আছে! এ কী ভাবে সম্ভব? তাহলে এত দিন কি তার বাবা তাকে মিথ্যা কথা বলে এসেছে? কিন্তু কেন? অবিনাশ বাবু তিস্তার দিকে ফিরে বলতে লাগলেন,
— “আমি জানি রে মা, তোর মনে এখন অনেক প্রশ্ন। আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই তো তোকে এখানে এনেছি। আমার আর মৃদুলার শৈশবের প্রেম পরিণতি পেয়েছিল আমাদের বিয়ের মাধ্যমে। তখন আমার আর্থিক অবস্থা আজকের মত ভালো ছিল না, কাপড়ের দোকানটা এত বড় ছিল না। আয় হত সামান্যই। তারপর আমাদের কোল আলো করে তুই এলি। এর পর থেকেই তোর মায়ের সাথে আমার সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরলো। তার কারণ হল আমার বন্ধু প্রফুল্ল। উচ্চবিত্ত বনেদী পরিবারের একমাত্র বংশধর ছিল সে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে দিল্লিতে মোটা মাইনের চাকরি করতো সে। আমার বিয়ের পর এক দুই বার সে এসেছিল আমার আর তোর মায়ের সাথে দেখা করতে। তখনও বুঝিনি যে ওর আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়বে মৃদুলা, যে তোর জন্ম হবার কয়েক মাসের মধ্যেই আমাকে ছেড়ে, শৈশবের সমস্ত ভালোবাসাকে ছেড়ে সে প্রফুল্লর হাত ধরবে! আমাকে ত্যাগ করে প্রতিপত্তির নেশায় ওর সাথে দিল্লি চলে যায় মৃদুলা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ওর ভুল ভেঙে যায়। একাধিক নারীসঙ্গ এবং নানা বদ নেশাগ্রস্থ প্রফুল্লর আসল রূপটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে ওর সামনে। প্রতিদিনের নির্যাতন এবং লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফিরে আসে মৃদুলা। ততদিনে আমার কাছে ফিরে আসারও তার মুখ নেই। তাই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে একদিন একটি চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে মৃদুলা। ভাগ্যের ফেরে বেঁচে যায় সে, কিন্তু মাথায় চোট পেয়ে সমস্ত স্মৃতিশক্তি লোপ পায় তোর মায়ের। সাথে শুরু হয় মানসিক রোগীদের মত বিকারগ্রস্থ আচরণ। ওর বাপের বাড়িতে ওর এক দাদা বৌদি ছাড়া আর কেউ ছিল না। ওর দাদাও ছাপোষা চাকরি করতো। একদিন সেই আমাকে ডেকে সব কথা খুলে বলে, বলে যে বোনের চিকিৎসার খরচ সে আর চালাতে পারছে না। ততদিনে আমারও ব্যবসার অনেক উন্নতি হয়েছে, তাই আমাকেই অনুরোধ করে আবার মৃদুলার দায়িত্ব গ্রহণ করতে। আমি ওর কথা ফেলতে পারলাম না, মৃদুলাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম। সেদিন থেকে আজ অবধি ও এখানেই চিকিৎসাধীন। রমা ওর দেখাশোনা করে। তোকে এত কথা আগে জানাতে চাইনি, তাই তোর কাছ থেকে গোপন করে রমাকে ফোন করে তোর মায়ের খবরাখবর জিজ্ঞাসা করতাম এতদিন। কিন্তু আজ মনে হল তোকে সব কথা জানানো উচিত, তাই…”
তিস্তা ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মৃদুলা দেবীও নিজের শীর্ণকায় কম্পিত হাতগুলো রাখলেন তিস্তার পিঠে। হঠাৎ বিদ্যুতের চমকের মতো তিস্তার মনে একটি উপলব্ধি জাগল…এত বছর আগে বাবাকে ত্যাগ করে ধনসম্পদের পেছনে ছুটে তার মা যে ভুলটা করেছিল, আজ সে নিজেও তো একই ভুল করতে চলেছে সৌমিকের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে অমিতাভকে বিয়ে করে! সেও তো তার মায়ের মতই নিজের শৈশবের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ছুটে চলেছে অর্থ আর প্রতিপত্তির দিকে! সত্যিই সৌমিককে ছেড়ে সে কী সুখে থাকতে পারবে অমিতাভের সাথে? অমিতাভের সাথে হয়তো আর্থিক নিরাপত্তা আছে, কিন্তু ভালোবাসা? সে কি কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যও ভালোবেসেছে অমিতাভকে? নাহ, এখনো যে তার হৃদয়ে সেই স্থান অধিকার করে আছে সৌমিক…শুধু সৌমিক! আর তার সাথেই সকল সম্পর্ক সে ছিন্ন করতে চলেছে! না, বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে…সৌমিকের আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন আজ থেকে তিস্তা আর কারোর নয়, শুধুমাত্র তার! সৌমিকের উপার্জন কম তাতে কি হয়েছে, তিস্তা নিজেও তো চাকরি করে। আজ তো সমাজে মেয়েরাও পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সংসারের হাল ধরছে, তাহলে সে কেন তা পারবে না? মিথ্যা অর্থের প্রতি আর লোভ নেই তিস্তার মনে, সে তার ফোনটা বার করে ডায়াল করলো অমিতাভের নম্বর। তারপর ফোনটা কানে ধরে শুধু বললো,
— “আমায় ক্ষমা করবেন অমিতাভ বাবু…আমি আপনার সাথে বিয়ে করতে পারবো না।”
তারপর কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিল তিস্তা। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সে ডায়াল করল সৌমিকের নাম্বার।
পড়ন্ত বিকালে গঙ্গার ধারের এই নির্জন স্থানটা বড়ই মনোরম। সৌমিকের বুকে মুখ গুঁজে এখনো কেঁদে চলেছে তিস্তা। সৌমিকের দুই হাতের আঙ্গুলের হালকা ছোঁয়া এলোমেলো ভাবে খেলা করছে তিস্তার খোলা চুলের মাঝে। আকাশে অস্তমিত সূর্যের কাছ দিয়ে নিজেদের বাসার ফিরতে ব্যস্ত পাখির ঝাঁক। ওদিকে নদীর বুকে ভাসমান কোন এক নৌকা থেকে ভেসে আসছে মাঝি ভাইয়ের অস্পষ্ট কণ্ঠে ভাটিয়ালি গানের মিঠে সুর।
(সমাপ্ত)